Thursday, February 19, 2015

অমর প্রেমিক

ইন্দ্র নবম শ্রেণীর ছাত্র। সবেমাত্র সে যৌবনের অপরূপ বসন্তে পদার্পণ করিয়াছে। সে ১৫ পার করিয়া ১৬ বছরে পদার্পণ করিয়াছে কিন্তু তাহার বুদ্ধিমত্তা ৫০ বছরের বৃদ্ধকেও নিঃসন্দেহে ছাড়াইয়া যাইবে। ইন্দ্র পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ হইলেও দুষ্টুমিতে তাহার জুড়ি নাই। সে গণিতের শিক্ষিকা অমৃতা ম্যাডামকে অত্যন্ত পছন্দ করে। ম্যাডাম যখন শ্রেণীকক্ষে ক্লাস নিতে ব্যস্ত থাকেন,তখন ইন্দ্র ম্যাডামের জ্যোতির্ময় চন্রবদনের পরে অপলক দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে। ইন্দ্র ম্যাডামকে লইয়া আকাশ কুসুম চিন্তায় সমাধিস্থ হইয়া হৃদয়-রাজ্যের কল্পিত স্বর্গে পদার্পণ করে। সেই কল্পিত স্বর্গের জগতে ইন্দ্র হইল স্বর্গের অধিপতি এবং অমৃতা ম্যাডাম তাহার প্রধান অপ্সরী। ইন্দ্র সেখানে ম্যাডামকে লইয়া প্রেম প্রেম খেলায় মাতিয়া উঠে। একদিন ম্যাডাম ইন্দ্রের সব হাল-চাল উপলব্ধি করিয়া তাহাকে বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে আসিতে বলিল।

ম্যাডামঃ ইন্দ্র তুমি আমার দিকে অমন দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাক কেন? তুমি কি চাহিতেছ?

 ইন্দ্র ম্যাডামের কথার উত্তর না দিয়া একটাখানা খাতা লইল। তারপরে সে খাতা খানাতে লিখিল,১+১=৩;১+১=২;১+১=১১ এবং ইন্দ্র এই খাতাটা ম্যাডামের দিকে আগাইয়া দিয়া বলিল,‘‘  ম্যাডাম, আপনি কি এসবের অর্থ বোঝেন?”

ম্যাডামঃ না(একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন)। তুমি বলিয়া দাও।

 ইন্দ্র: ১+১=৩ হয় সামান্য নর-নারীর জন্য। অর্থাৎ, একজন নর ও নারীর মিলনের ফলে একটা বাচ্চা উৎপন্ন হইয়া থাকে।১+১=২ হয় ব্যাপারীদের জন্য।  অর্থাৎ,ব্যাপারের সময় এক টাকা আর এক টাকা মিলিয়া দুই টাকা  হইয়া থাকে। ১+১=১১ হইয়া থাকে সিদ্ধ-সাধকদের জন্য। অর্থাৎ,সাধকেরা প্রথমে কোন ভাল কাজ আরম্ভ করে;অতঃপর যখন তাহারা সিদ্ধি লাভ করে তখন সমাজের বাকি ১০ জন তাহাদের সহিত যোগ দেয়।আর ১+১=১ হয় প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য।অর্থাৎ, একজন প্রেমিক ও একজন প্রেমিকার মন যখন মিলিয়া এক হয় তখন তাহাকে প্রেম বলে।

ম্যাডামঃ তোমার বুদ্ধিমত্তা তো দেখিতেছি পিথাগোরাসকেও ছাড়াইয়া যাইবে।তোমাকে প্রশ্ন করিলাম কি? আর তুমি এসব দেখাচ্ছ! এসবের মানে টা কি?ইন্দ্র: আসলে সত্য কথা বলিতে কি, আমি আপনাকে খুবই পছন্দ করি ম্যাডাম।

ম্যাডামঃ তাহা হইলে তুমি বলিতে চাহিতেছ,তুমি আমাকে ভালোবাসো?

ইন্দ্র: হাঁ,ম্যাডাম। আমি আপনাকে আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালবাসি। আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচিবনা ম্যাডাম।

ম্যাডামঃ তোমার বয়স কত?

ইন্দ্র: ১৬ বছর।  

 ম্যাডামঃ আসলে ইন্দ্র,১৬ বছর বয়সটা হইল জীবনের স্বর্ণময় সময়।রাত যেমন দিনের পিছনে পাগলের ন্যায় ছুটিয়া মরে তেমনি দিনও রাত্রিকে ধরিবার জন্য পাগল। কিন্তু এমন একটা সময় রহিয়াছে যখন সূর্য উদিত হই এবং রাতের অন্তিম সময় চলিয়া আসে। সে সময়কে বলা হয় ব্রহ্মবেলা। ইহাই ২৪ ঘন্ঠার মধ্যে সর্বোত্তম সময়। ১৬ বছর বয়সটাও তদ্রূপ। ইহা যৌবন ও কৈশোরের মধ্যকার সন্ধিক্ষণ। ইহাই যৌবন ও কৈশোরের মধ্যকার স্বর্ণময় সেতুবন্ধন। এ সময়ে বিশ্ববিধাতা মানুষের চোখে রঙিন চশমা পরাইয়া দেন।

ইন্দ্র: তাহা হইলে আপনি বলিতে চাহিতেছেন,‘‘আমি আপনাকে ভালবাসি না। এ সমস্ত আমার বয়সের দোষ।’’

ম্যাডামঃ হাঁ। এ সমস্ত তোমার বয়সের কারণেই ঘটিতেছে। কেননা এ বয়সে রঙ-বেরঙের ভাব  মানুষের বুদ্ধিকে ঘিরিয়া রাখে। যাহার ফলে মানুষ চাহিলেও ভাল থাকিতে পারে না।এসব করিবার জন্য তোমার সামনে অনেক সময় রহিয়াছে। এখন তোমার পড়াশোনা  করিবার সময়। তোমার ছাত্র জীবনটাকে ভালভাবে কাজে লাগাও,কেমন।

ইন্দ্র: ম্যাডাম,আমি সত্যি বলিতেছি,‘‘আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচিবনাএই বলিয়া  ইন্দ্র ম্যাডামের হাতটাকে লইয়া তাহার আপন বক্ষের বাম পাশে রাখিয়া বলিতে লাগিল,‘‘ এইখানে আপনার জন্য কতটা হাহাকার, কতটা ব্যাকুলতা তাহা হয়ত আপনাকে বোঝাইতে পারিবনা;কিন্তু আমার জন্ম হইয়াছে কেবলমাত্র আপনাকে ভালবাসিবার জন্য।

ম্যাডামঃ তোমার সাহস তো কম না। আমি ভাবিয়াছিলাম এসব তোমার বয়সের দোষ। কিন্তু আমি যাহা দেখিতেছি তুমি একটা আস্ত ইঁচড়েপাকা। এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে হইতে দূর হইয়া যাও।

ইন্দ্র: আপনি যদি আমাকে মরিতে বলেন তাহা হইলে আমি আপনার জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে পারি। কিন্তু আপনাকে ভুলিয়া যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে।

ম্যাডামঃ তোমার ন্যায় বেয়াদব ছেলে আমি এ জনমে আর একটা দখিনাই। দাঁড়াও! তোমার শাস্তির ব্যবস্থা করিতেছি। এই বলিয়া ম্যাডাম প্রিন্সিপাল স্যারকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। প্রিন্সিপাল সবকিছু শোনার পরে ইন্দ্রকে আচ্ছা করিয়া পিটিয়া স্কুল হইতে তাড়াইয়া দিলেন।  তাহারপরে ইন্দ্র একদিন গভীর রাতে ম্যাডামের বাড়ীতে যাইয়া ম্যাডামকে বলিল,‘‘ ম্যাডাম আমি আপনাকে জন্ম-জন্মান্তর ধরিয়া ভালবাসিয়া আসিতেছি এবং  জন্ম-জন্মান্তর ধরিয়া ভাল বাসিয়া যাইব। আপনি যদি আমাকে ভালবাসিয়া না-ই থাকেন তাহা হইলে আমি চলিলাম। এ জন্মে যদি আপনার হইতে না-ই পারিলাম, তাহা হইলে বাঁচিয়া থাকিয়া আমার লাভ কি?”

ম্যাডামঃ আমি তো বলিয়াছি,‘‘আমি তোমায় ভালবাসি না ।যাও তুমি বরং আত্মহত্যা করগে।ম্যাডামের কথা শুনিয়া ইন্দ্রের হৃদয় কমল ভাঙ্গিয়া টুকরা টুকরা হইয়া গেল। ইন্দ্র বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করিয়া পাশের গ্রামের বনে আত্মহত্যা করিবার জন্য চলিয়া গেল। সেখানে ইন্দ্র ২০০ বছরেরও অধিক বয়স্ক বিরাটাকার বটগাছের উপরে উঠিয়া পড়িল। সে এখন উপর হইতে লাফাইয়া আত্মহত্যা করিবে। তাই শেষবারের চারিদিকটা দেখিয়া লইল।তারপর ইন্দ্র বিশ্ববিধাতা ও তাহার সমস্ত সৃষ্টির দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া ম্যাডামের উদ্দেশে বলিল,‘‘ম্যাডাম! আজ আমি ছোট বলিয়া আমাকে গ্রহণ করিলেনা। কিন্তু আমি ছোট নই ম্যাডাম।আপনি শুধুমাত্র আমার শরীরটাকেই দেখিয়াছেন আমাকে দ্যাখেন নাই। পরজন্মে আমি আপনার স্বামী হইয়া জন্মাইব। এই বলিয়া ইন্দ্র গাছ হইতে লাফাইয়া পৃথিবীর নাট্যমঞ্চ হইতে বিদায় লইতে যাইতেছিল। গাছার নীচে এক মহান ঋষি গভীর ধ্যানে সমাধিস্থ হইয়া ছিলেন। তিনি ইন্দ্রের এ দশা দেখিয়া তাহাকে গাছ হইতে নামাইয়া তাহার আশ্রমে লইয়া গেলেন। গুরুদেব(ঋষি) ইন্দ্রকে বলিলেন,‘‘তুমি যে কাজটা করিতে যাইতেছিলে তাহা সর্বশক্তিমান দয়াময়ের দৃষ্টিতে মহাপাপের কাজ।

তাহারপরে তিনি ইন্দ্রকে স্নান করিয়া আসিতে বলিলেন। স্নান করিবার পর গুরুদেব ইন্দ্রকে পদ্মাসনে বসাইয়া তাহার শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর ধ্যান করিতে বলিলেন। এভাবে ইন্দ্র ধ্যান করিতে করিতে আলফা,থিটা ও ডেল্টা লেভেল পার করিয়া ZERO(শূন্য) লেভেল এ পৌঁছাইল।ZERO(শূন্য) লেভেলে পৌঁছাইলে মানুষ চিন্তাশূন্য হইয়া যায়। তখন যোগ সাধনার পরিভাষায় তাহাকে সমাধি লাভ করা বলা হইয়া থাকে। সমাধির মধ্যে সর্বোত্তম সমাধি হইল নির্বিকল্প সমাধি ।যে একবার নির্বিকল্প সমাধি লাভের সৌভাগ্য অর্জন করিতে পারে সে মানব হইতে মহামানবে পরিণত হইয়া যাই।কেননা  নির্বিকল্প সমাধিতে মানুষের আত্মাটা;যিনি সর্বশক্তিমান,যিনি মৃত্যুঞ্জয়,যাহার আজ্ঞায় এ বিশ্বসংসার চলায়মান তাঁহার সহিত সংযুক্ত হইয়া যাই।এভাবে ইন্দ্র নির্বিকল্প সমাধি লাভ করিয়া একাধারে ১২ বছর ধ্যানমগ্ন হইয়া থাকিল। অগ্নি যেমন সমস্ত ময়লা আবর্জনাকে দগ্ধ করিয়া এ মহামায়াকে পাপ-মুক্ত তথা সুন্দর করিয়া থাকে তদ্রূপ কঠোর যোগসাধনার অগ্নিতে দগ্ধিত হইয়া ইন্দ্রের চিত্তের সব বৃত্তিগুলো জ্বলিয়া পুড়িয়া ভস্ম হইয়া গেল। যাহার ফলশ্রুতিতে ইন্দ্র জ্ঞানের অমৃতময় পেয়ালায় চুমুক দিয়া সর্ব জ্ঞানের মালিকের নিকট হইতে জ্ঞানযোগ প্রাপ্ত হইল।তাহারপরে মহাজ্ঞানী ইন্দ্র বুঝিতে পারিল প্রেমের প্রকৃত অর্থটা কি? ইন্দ্র বুঝিল প্রেম সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার পরিভাষা। প্রেম মানব জীবনকে কল্যাণকর,আনন্দময় ও মহৎ করিয়া তোলে।প্রেমের সহিত কামনা বাসনার কোন সম্পর্ক নাই।প্রেম হইল দেব ভাব আর কাম হইল পশু ভাব। প্রেম যেমন সর্বশক্তিমানের সান্নিধ্য লাভ করাইতে পারে তেমনি কাম মানুষে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নামাইয়া দিতে পারে। ইন্দ্র বুঝিতে পারিল যে প্রেম কেবল প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে বরং সর্বশক্তিমান স্রষ্টা ও তাহার সৃষ্টির প্রতি গভীরতম ভালবাসাই প্রকৃত প্রেম। তাই ইন্দ্র মহান স্রষ্টা ও তাহার সৃষ্টির প্রেমে পাগল হইয়া ঘর ছাড়িয়া দিল। তাহার পরে যেখানে  স্রষ্টার সৃষ্টি জীবের দুঃখ-দুর্দশা দেখা দিতো ইন্দ্র সেখানে পাগলের ন্যায় সাহায্য করিবার জন্য ছুটিয়া যাইত। কেননা সে হইল অমর প্রেমিক।                                                                             (সমাপ্ত)